সন্দ্বীপ আনন্দ পাঠশালা: এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ
মুহাম্মদ জাফর ইকবাল
বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড হতে বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপের সমস্যা যেমন অন্য এলকা থেকে ভিন্ন, তেমনি এর সমাধানের পথও ভিন্ন। নানাবিধ সমস্যা আর সীমাবদ্ধতার কারণে সন্দ্বীপ ছাড়ছেন অনেকেই। তবে সন্দ্বীপ ছাড়ার যতগুলো কারণ রয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে ভালো মানের বা নির্ভরযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব। বিশ্বায়নের এ যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার উপযোগী করে সন্তানদের গড়ার জন্য সচেতন প্রত্যেকেই উদগ্রীব। দেশবিদেশে ঘুরে এ বোধ বা চেতনা সবার মাঝে সৃষ্টি হয়েছে যে, শিক্ষাই শক্তি। শুধু মানসম্মত শিক্ষাই একজন শিক্ষার্থীকে সততা, যোগ্যতা ও নৈতিকতার সমন্বয়ে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। ঢাকা-চট্টগ্রাম তথা শহরের সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে গুণগত শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির এক কঠিন অঙ্গীকার নিয়ে সন্দ্বীপে ২০১১ শিক্ষাবর্ষ থেকে যাত্রা শুরু করেছে সন্দ্বীপ আনন্দ পাঠশালা। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক দানবীর একক অর্থায়নে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। কিন্তু দল, মত নির্বিশেষে কয়েকশত লোকের অর্থায়নে ও সহযোগিতায় এ রকম আয়োজন বাংলাদেশের কোথাও আছে বলে জানা নেই। সন্দ্বীপের লোকজনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত “নেবুলা প্রোপার্টিজ” নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এর উদ্যোক্তা হলেও পরবর্তীতে নানা দল, মত ও পেশার লোকদের এর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। ১৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি এটি পরিচালনা করছে।
একটি ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সুন্দর, মনোরম, প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই জরুরি। অবকাঠামোগত সৌন্দর্য শিশুর মনকে আরো বেশি আকৃষ্ট করে। সন্দ্বীপ আনন্দ পাঠশালার অবস্থান মূল রাস্তার একেবারে পাশে নয়, আবার বেশি দূরেও নয়। সন্দ্বীপের কেন্দ্রস্থলে মুছাপুর সেনের হাটের পূর্বপাশে মাস্টারপাড়া এলাকায় বিশাল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তার ক্যাম্পাস গড়ে তুলেছে। মাঠের একপাশে রয়েছে শিশুদের খেলাধুলার জন্য দোলনা, স্লিপারসহ অনেকগুলো রাইড। ছোটদের জন্য ক্লাসরুমের মাঝে রয়েছে প্লাস্টিকের অনেকগুলো রাইড। সন্দ্বীপের শিশুরা মাইক্রোতে চড়ে শিবেরহাট, আলী মিয়ার বাজার, হক সাহেবের বাজার, নাজিরহাট, বাতেন মার্কেট এলাকা থেকেও এসে আনন্দ পাঠশালায় আনন্দের সাথে পড়ে। শিক্ষকদের সবাইকে কম্পিউটারে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। বিশাল হলরুমে প্রতিসপ্তাহে মাল্টিমিডিয়া ওভারহেড প্রজেক্টর ব্যবহারসহ সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম শিশুদের শিক্ষার পরিবেশকে আনন্দঘন এবং প্রতিযোগিতামূলক করে তুলেছে। হলরুমে রয়েছে নিজস্ব সাউন্ড সিস্টেম। পাঠশালাতেই তৈরি টিফিন পরিবেশিত হয় প্রতিদিন। বিকেল ৪টা পর্যন্ত যাদের ক্লাস, তারা দুপুরের খাবার হয়তো বাড়ি থেকেই নিয়ে আসে অথবা পাঠশালার ব্যবস্থাপনায় খেয়ে নেয়। মোটামুটি কঠিন একটি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিন টিফিন পিরিয়ডে ঐ দিনের ক্লাসের সমস্যা পর্যালোচনা, সপ্তাহে একদিন ক্লাসভিত্তিক শিক্ষার্থীদের অবস্থা পর্যালোচনা, ডায়রির মাধ্যমে প্রতিদিনের পড়ালেখা সম্পর্কে অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করা, বছরের শুরুতে একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রদান, নানাবিধ শিক্ষা উপকরণের সমাহার ইত্যাদি সন্দ্বীপ আনন্দ পাঠশালাকে একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। আর এ মেধাবী শিক্ষকদের গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যিনি সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি হচ্ছেন সন্দ্বীপেরই একজন কৃতী শিক্ষক যিনি ইতোপূর্বে মগধরার মতো প্রত্যন্ত এলাকার একটি স্কুলকে মেধাবৃত্তি, ক্রীড়া সকল ক্ষেত্রে, শুধু সন্দ্বীপে নয়, চট্টগ্রাম জেলাতেও শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন মাস্টার জামাল উদ্দীন। তাঁর মৃত্যুর পর
ক্লাসটেস্ট, সাপ্তাহিক ও মাসিক পরীক্ষার খাতা অভিভাবকদের কাছে প্রেরণ, সাময়িক পরীক্ষার পর ক্লাসভিত্তিক অভিভাবকদের নিয়ে উপস্থিতি, হাতের লেখা, অংকন, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সকল বিষয়ে ব্যাপক পর্যালোচনার মাধ্যমে শিক্ষক, অভিভাবক, পরিচালনা পরিষদ প্রত্যেকেরই দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শাখায় প্রায় ৫০ জন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। নার্সারি, কেজি ও ১ম শ্রেণিতে ২ জন করে শিক্ষক থেকে হাতে কলমে শিশুদের শিক্ষাদানের চেষ্টা করে থাকেন। সুন্দর হস্তাক্ষর, ইংলিশ স্পোকেন, শুদ্ধ উচ্চারণ, সংগীত ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। প্রতিদিন পুনরালোচনা ক্লাসের মাধ্যমে ক্লাসের পড়া ক্লাসেই আদায় করার ব্যবস্থা রয়েছে। ১০টা থেকে শুরু হলেও সকাল ৮.৩০ মিনিট থেকেই বৃত্তি পরীক্ষার্থী ও ১ম শিফটে আগত শিক্ষার্থীদের পড়া শুরু হয়ে যায়। পাঠশালার বেশ কয়েকটি ব্যাচ ইতোমধ্যে এসএসসি পাস করেছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী বুয়েট, মেডিকেল কলেজ, ডিডিসি, দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। দেশের বাইরে তথা জাপান, অস্ট্রেলিয়া, পোলান্ডের মতো জায়গায় বিভিন্ন উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করছে কয়েকজন।
শিশুদের প্রতিভা বিকাশে এখানে বহুমাত্রিক সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম চালু রয়েছে। “আনন্দ পাতা’ নামক একটি সাময়িকী প্রকাশিত হচ্ছে প্রধানত শিক্ষার্থীদের লেখা নিয়ে।
কফি কালারের প্যান্ট ও পাজামা, গিয়া কালারের জামা, ছাত্রদের নেকটাই এবং ছাত্রীদের মাথায় স্কার্ফ, পায়ে কালো সু এবং সাদা মোজা; শিক্ষকদের আলাদা এপ্রন শিক্ষার সুন্দর একটি আবহ তৈরি করে।
সন্দ্বীপের শিক্ষার অতীত নিয়ে অনেকেই গর্ব করেন। তবে বর্তমান নিয়েও গর্ব করার মতো দু'একটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে সন্দ্বীপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সবকিছুর আগে প্রয়োজন দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে রেখে এ সকল প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় সবার এগিয়ে আসা। সবার সার্বিক সহযোগিতা, পরামর্শ এবং পরিচালনাগত দায়িত্বশীলতা ও অঙ্গীকার অব্যাহত থাকলে সন্দ্বীপ আনন্দ পাঠশালা হতে পারে জাতীয় মানের একটি মডেল প্রতিষ্ঠান।